গঙ্গা নদী (Ganges River) ভারত ও বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বৃহৎ নদীপ্রণালী সমূহের মধ্যে অন্যতম। এর ইংরেজি উচ্চারণ ‘গ্যানজেস’ সংস্কৃত নাম ‘গঙ্গা’-এর অপভ্রংশ, যা একজন গ্রিক ইতিহাসবেত্তা কর্তৃক প্রথম ব্যবহূত হয়েছিল। সমগ্র ভারতবর্ষ এবং যে সকল স্থানে ভারতীয় সভ্যতার বিস্তৃতি ঘটেছিল সে সব অঞ্চলে গঙ্গা নামটি সুপরিচিত। এর নিষ্কাশন অববাহিকা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের একটি এবং এ অঞ্চলেই ইন্দো-আর্য সভ্যতা বহু শতাব্দী ধরে বিকশিত হয়েছে। গঙ্গা ছাড়াও এ নদীপ্রণালী অনেক গুরুত্বপূর্ণ শাখা নদীসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে যমুনা, কালী, কার্ণালি, রামগঙ্গা, গন্ডক এবং কোশি। এসবের সবকটিই হিমালয় পর্বতমালা থেকে উৎসারিত এবং প্রধানত গলিত বরফ থেকে এদের সৃষ্টি। মূলত গঙ্গা দুটি উপনদী থেকে সৃষ্ট- ভাগীরথী এবং অলকানন্দা।
তিববত-ভারতের সীমান্তের সন্নিকটে গঙ্গা নদীর উৎপত্তি। প্রচলিতভাবে ভাগীরথীকে মূল গঙ্গা হিসেবে মেনে নেওয়া হয় যদিও অলকানন্দা তুলনামূলকভাবে বৃহত্তর নদী। গঙ্গার মূল উৎস হিমালয় পর্বতমালার প্রায় ৩,৯০০ মিটার উচ্চে অবস্থিত গঙ্গোত্রী হিমবাহ। গঙ্গোত্রী তীর্থস্থানটি গোমুখ থেকে কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে। ভাগীরথী নদী গঙ্গার পশ্চিমদিকের উপনদী জাহ্নবীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে মূল হিমালয় থেকে সামান্য উত্তরে এবং এ স্থানটি গঙ্গোত্রী মন্দির থেকে প্রায় ১১ কিমি নিচে। নদীর সম্মিলিত ধারাটি এর পরে হিমালয় অঞ্চল ভেদ করে একটি বিশাল গিরিসঙ্কটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ গিরিসঙ্কটে নদীর তলদেশ উভয় পার্শ্বের পর্বতচূড়া থেকে প্রায় ৩,৯৬০ মিটার নিচে।
নদীটি দক্ষিণ-পূর্বাভিমুখে ভারতভূমিকে অতিক্রম কওে প্রবাহিত বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তে নবাবগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ভূখন্ডে প্রবেশ করেছে। দেশের অভ্যন্তরেও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে এটি গোয়ালন্দঘাটের কাছে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়ে আরও ভাটিতে চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। যমুনার সঙ্গে সঙ্গমস্থল থেকে মেঘনা সঙ্গম পর্যন্ত নদীটির নাম পদ্মা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গঙ্গা নদীর সমগ্র প্রবাহপথই ‘পদ্মা’ নামে বহুল পরিচিত, যদিও তা সঠিক নয়। যমুনা সঙ্গম পর্যন্ত গঙ্গার সর্বমোট দৈর্ঘ্য ২,৬০০ কিমি এবং এর নিষ্কাশন অঞ্চলের আয়তন ১০,৮৭,৪০০ বর্গ কিমি যার মাত্র ৪৬,৩০০ বর্গ কিমি এলাকা বাংলাদেশ ভূখন্ডের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে এর উপনদী কেবল একটি মহানন্দা, যেখানে শাখানদী রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যেমন: ইছামতি, নবগঙ্গা, ভৈরব, কুমার, গড়াই-মধুমতি এবং আড়িয়াল খাঁ।
গঙ্গা একটি গুরুত্বপূর্ণ জলশক্তি প্রণালী যা পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপগুলির একটিকে গঠন করেছে। এ বদ্বীপভূমির আওতাভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের অধিকাংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি বৃহত্তর অংশ। গাঙ্গেয় বদ্বীপভূমির উন্নয়নের দীর্ঘ ইতিহাসে দেখা যায়, নদীটি পূর্বের প্রবাহপথ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সরে এসে বঙ্গের নিম্নভূমির বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে। গঙ্গা এবং তার উপনদী এবং শাখানদী এ বদ্বীপভূমির উন্নয়নে সুদীর্ঘ সময় জুড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। গঙ্গা-যমুনা-মেঘনা প্রণালীর বদ্বীপ মোহনার নদীগুলির সম্মিলিত নিষ্কাশিত পানি অপসারণের পরিমাণ গড়ে ৩৫,০০০ কিউসেক। গঙ্গার বর্ষা মৌসুমে পানি অপসারণের পরিমাণ ৭৬,০০০ কিউসেক পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং সে সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে পলিবাহিত হয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ প্রায় ১৫,০০০ কিউসেক এবং স্বাভাবিকভাবেই এ সময়ে পলি বহনের পরিমাণ খুবই সামান্য হয়ে থাকে। বদ্বীপ অংশে নদীর প্রশস্ততার পরিসীমা ১.৬ থেকে ৮ কিমি এবং কখনো কখনো এখানে কিছুটা বিনুনী প্রবাহের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় যদিও এটি একটি সর্পিল প্রকৃতির নদী। গঙ্গার বদ্বীপভূমির শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক শহর গৌড় এর নিকট থেকে। নদীর বর্তমান প্রধান শাখাটি দক্ষিণ-পূর্বাভিমুখে প্রবাহিত ও বাংলাদেশ ভূখন্ডে এ প্রবাহ পদ্মা নামে বহুল পরিচিত। কয়েক শতাব্দী পূর্বে বঙ্গ সমভূমিতে গঙ্গার প্রধান নদীখাত ছিল হুগলি। ভাগীরথী, জালাঙ্গী এবং মাথাভাঙ্গা শাখা নদীসমূহের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে এদের নদীয়া নদী বলা হতো। উল্লেখ্য যে, গঙ্গা নদীতে ভারতের নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে। [কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ]
0 comments:
Post a Comment