সেদিন জাতীয় গ্রন্থাগারের সামনে ফুটপাতের এক বইয়ের দোকানে কার্ল
মার্কসের "ডাস ক্যাপিটাল "বইটা পেয়ে খুব মনযোগ সহকারে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে
দেখছিলাম। হঠাৎ চোখ অন্যদিকে ফেরাতেই দেখি আদৃতা ইশতিয়াকের সাথে এক প্লেটে
ফুচকা খাচ্ছে।
ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম কিছুটা!
ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম কিছুটা!
.
আদৃতা আমার ক্লাসমেট ছিল, চার বছরের প্রেমিকাও।
যেদিন মাস্টার্সের ভাইভা দিলাম সেদিনই আদৃতার সাথে আমার ব্রেক আপ হয়ে গেল।অর্থাৎ ইউনিভার্সিটির শেষ দিনে এসে আদৃতাকেও হারালাম।তারপর প্রায় দুটো বছর কেটে গেছে, আদৃতার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি আমার,চোখের দেখা তো আরো পরের ব্যাপার।
.
আজ হঠাৎ আদৃতাকে দেখলাম, সাথে ইশতিয়াক।
ইশতিয়াক আমাদের সহপাঠী ছিল, আদৃতাকে পছন্দ করত। আদৃতার সাথে আমার সম্পর্ক আছে জেনেও ইশতিয়াক আদৃতাকে প্রপোজ করেছিল, ফোন দিয়ে এটা সেটা বলত। আদৃতা আমাকে এ ব্যাপারে জানাত, কিন্তু আমি কিছু মনে করতাম না। এর কারণ ছিল বেশ কয়েকটা। আমি আদৃতাকে বিশ্বাস করতাম খুব আর এটাও জানতাম আদৃতা কখনোই ইশতিয়াকের প্রতি দূর্বল হবে না কারণ ইশতিয়াককের মধ্যে ঈর্ষা করার মতন তেমন কিছুই খুঁজে পেতাম না আমি, যা আমার মধ্যে ছিল না।তাছাড়া ইশতিয়াক আমাদের ক্লাসমেট ছিল, আদৃতাকে ভাল লাগা এবং সেটা প্রকাশের অধিকার অবশ্যই ওর ছিল। আমি কখনোই চাইনি আদৃতার কাছে সংকীর্ণ মনের পরিচয় দিতে।
.
আমাদের ব্রেক আপের পেছনেও ইশতিয়াকের কোন ভূমিকা ছিল না। কলেজ লাইফে আদৃতার একটা ছেলেকে ভাল লাগত, কিন্তু আদৃতা কখনোই সেই ছেলেকে এই কথাটা বলেনি। মাস্টার্সে এসে আদৃতার সাথে সেই ছেলেটার যোগাযোগ হয় আবার,আদৃতা ওর দুর্বলতার কথা ছেলেটিকে জানায়। কিন্তু ছেলেটার অন্যত্র রিলেশন তখন। এই সমস্ত ব্যাপারটা আমি জানতে পারি, আমার তাতেও আপত্তি ছিল না কেননা আদৃতাকে আমি ভালবেসেছিলাম। আমি সব মেনে নিতে পারতাম, শুধু মানতে পারিনি এটা আদৃতা আমার সাথে রিলেশনের ব্যাপারটা সেই ছেলের কাছে গোপন করেছে।
.
সন্দেহ একবার আসলে সেটা একটা সম্পর্ককে শেষ পর্যায়ে না নিয়ে সরে না একবিন্দু। এই নিয়ে তিক্ততার সৃষ্টি হলো, অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ!
অভিমান! কিন্তু সেই অভিমান ভাঙানোর মতন মনের অবস্থা তখন কারো নয়।সেই নিয়ে আবার বাদ-বিবাদ!
সব শেষে বিচ্ছেদ।
.
একে তো ইউনিভার্সিটির সেই সোনালি সময় হারালাম, তারপর আবার আদৃতাকে। চার বছরের সম্পর্কও নিতান্তই কম সময় নয়। সব মিলিয়ে এতটাই বিষণ্ণ থাকতাম যে,পরের একটা বছর আমার জীবন থেকে কিভাবে হারিয়ে গেল আমি বুঝে উঠতে পারলাম না এতটুকুন।
.
তারপরে আরো একটা বছর গেল।
এসময়ে আদৃতাকে কিছুটা মনের আড়াল করতে পেরেছিলাম আমি।
কিন্তু আমার ধারণারও বাইরে ছিল ইশতিয়াকের সাথে এই সময়টাতে আদৃতার যোগাযোগ থাকতে পারে।
আজ এক প্লেটে ফুচকা খাওয়া অনেক রকম অর্থই বহন করে।
.
আমি দ্রুত সরে পড়ব সেখান থেকে, কিন্তু আদৃতা দেখে ফেলল আমাকে; চোখে চোখ আটকে গেল। আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম আদৃতা কেঁপে উঠল খানিকটা। হয়তো ওর শরীরের লোম ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছে।
.
আমি কিছু না বলে একটু এগিয়ে ফুটপাতের একটা দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাটছিলাম, কষ্ট হচ্ছিল খুব। এতদিন ভুলে থাকতে পারলেও, আজ যেন সমস্ত ব্যথারা একসাথে মোচড় দিয়ে জেগে উঠলো হৃদয়ের মধ্যে। ওদের দুজনকে আজ একসাথে দেখে শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার কয়েকটি চরণ মনে পড়ছিল খুব,
.
দুইজনে পাশাপাশি, মাঝে কি পথিক নেই কোনো,
এখন দেবতা দেখুক দুনয়নে,
শিশিরে পায়ের ধ্বনি সুদূরতা অধীর জলধি
শুধু বহে যায় হাওয়া ।
আজ আর কেউ নেই, মাঝে মাঝে কার কাছে যাব ।
.
সেদিন রাতে দুটো ঘুমের ওষুধ ডেনিক্সিল খেয়ে লাইট অফ করে চুপচাপ শুয়েছিলাম। কখনো কখনো মনের বিষণ্ণতা নিরুপণের একটা যন্ত্র আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় খুব, কিন্তু মনটাই তো বিমূর্ত!
যা দেখা যায় না তার আবার মাপকাঠি কি?
আদৃতার সাথে স্মৃতিগুলো, আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল মাঝরাতে। কখন ঘড়িতে দুটো বেজে গেছে,খেয়াল করিনি।
.
এতরাতে অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে ফোন এলো।
রিসিভ করব না ভাবছিলাম, তবু রিসিভ করে ফেললাম।
-হ্যালো। কে?
ও পাশে থমথমে নিরবতা।প্রায় একমিনিট পর।
-আমি, চিনতে পারছিস?
-আদৃতা?
-হু, কেমন আছিস রে?
এবার আমি চুপচাপ। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।
আদৃতাই আবার বলল,
-তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে, শোন, প্লিজ তুই ফোনটা রেখে দিস না।
-বল?
- আগে বল আমার কথা শেষ না হওয়ার আগে তুই ফোন রাখবি না?
-না রাখব না। বল?
-নারী হৃদয়ে শূন্যতা যে কি সে তোরা ছেলেরা বুঝবি না কিছুতেই, কি করে বুঝাব তোকে? তোর সাথে ব্রেক আপ হবার পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম খুব, নাওয়া খাওয়া ছেড়ে একেবারে যেন কৃষ্ণের জন্য চির বিরহিণী রাধা। কিন্তু আমাদের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গাটা হারিয়ে গিয়েছিল, আমরা আর একত্র হতে পারতাম না রে। যে কারণে ফিরিনি আর তোর কাছে,এতটা শূন্যতা বুকে চেপেও।
.
- আচ্ছা তারপর?
.
-আমার সেইদিনগুলোতে ইশতিয়াক নক করে যেত, হাজার রকম প্রসেসে তবু এভোয়েড করে যেতাম ওকে দিনের পর দিন। ও এভাবে এক বছর পর্যন্ত নক করেছে, আমি এড়িয়ে গেছি। এক বছর পর ওর জন্য মায়া হলো খুব, যে ছেলেটা তোর সাথে আমার সম্পর্ক থাকা অবস্থা থেকে নক করে আসছে তার ভালবাসায় সাড়া না দিতে পারি, তবে তুচ্ছ করার শক্তি আমার ছিল না। সঙ্গত কারণেই বন্ধুত্ব হয় ইশতিয়াকের সাথে, কথা বার্তায় আন্তরিকতা আসে।
.
-হু?
.
- তুই তো আমাকে তোর নিজের লিখা একটা কবিতা শুনিয়েছিস, কতবার! সেই কবিতার একটা লাইন ছিল,
একটা হৃদয়ের সবটা শুধু একজনের নয়!
জানিস দিনে দিনে তোর কথাটাই সত্যি হয়ে উঠলো, ইশতিয়াকের প্রতি কিছুটা দুর্বলতা আসল আমার মনে, তবে বিশ্বাস কর অতটা নয় যতটা তোর চোখে চোখ রেখে আমি অনুভব করতাম। তবু ইশতিয়াকের পীড়াপীড়ির মাত্রা আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাল, আমি সায় দিলাম। আমাদের সম্পর্কের বয়স এক মাস পূর্ণ হল কাল। শুনছিস?
.
- হ্যাঁ বল। ( এই দুটো শব্দ উচ্চারণ করতে যেয়ে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছিলাম, আওয়াজ বেরুচ্ছিল না। চোখ দুটো ভিজে উঠছিল)
.
-তুই কাঁদছিস? না?
-না।
-মিথ্যে বলছিস কেন অরণ্য?
- আদৃতা তোর মনে আছে সেই কথা, সেই দিন? আমরা দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাদের সন্তান হলে
তাদের বর্ণমালা শেখাব এভাবে "অ তে অরণ্য " আ তে আদৃতা।" আমাদের সেই দিনগুলো মিছে হয়ে গেল রে।
.
-হ্যাঁ অরণ্য। (এবার আদৃতা কেঁদে ফেলল বেশ শব্দ করেই)
.
-আমিও নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে, অনেকটা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে ফেললাম তবে তুই কেন করছিল অইসব অই ছেলেটার সাথে, আমাকে কিছু না জানিয়ে?
.
-আমাকে ক্ষমা করে দিস, আমি বুঝতে পারিনিরে।চারটা বছরে হৃদয়ের কতটা জায়গা নিয়েছিলি তুই, যেদিন পাশে ছিলি বুঝতে পারিনি। যখন চলে গেলি তখনি বুঝেছি ওই ছেলেটা শুধু ভাল লাগাই ছিল,ভাল আমি তোকেই বেসেছিলাম। বাদ দে সেসব কথা।
কেমন আছিস রে তুই? কি করছিস?
.
-আজ এতদিন পরে বুঝি তোর ইচ্ছে হল জানতে? তবু দুপুর বেলা তোর সাথে দেখা না হলে তুই কি ফোন করতিস আমায়? করতিস না।
.
-সেসব আমি কিছুই জানি না, শুধু তোর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল তুই ব্যথা পেয়েছিস অরণ্য। আকাশের মতন সীমাহীন যে অরণ্যের হৃদয় ছিল, সেও যেন হৃদয়ের ব্যথায় নীল হয়ে উঠছিল! বেদনার রঙ সত্যিই নীল! মনে হলো সত্যিটা না জানলে তুই ঘৃণা করে যাবি আমায় আজীবন, আর আমি মরমে মরমে মরে যাব!
.
-আমার কথা থাক আদৃতা। কেমন আছি এটা জেনে আর কি হবে? কি করছি এটা জেনে দরকার কী!
একজন অখ্যাত কবির একটি কবিতার দুটো চরণ মনে পড়ছে,
প্রিয় অন্ধকার
যেখানে নিজেকে লুকানো যায়!
অন্ধকার আমার প্রিয় রে আজকাল, আলোতে আসতে বড় ভয়! তুই আবার দেখে ফেলবি শেষে!
.
-তবু জানতে ইচ্ছে করছে যে খুব?
.
-করুক, তবু বলব না। তুই বরং ইশতিয়াককে নিয়ে সুখে থাক। তোর সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে, হয়তো জানলে ও খুব কষ্ট পাবে, আবার শুরু হবে সম্পর্কে সন্দেহ, ভাঙন। তুই সুখে থাক আদৃতা।
.
- আমি জানি না রে কিছু! আমার না আছে তোর কাছে ফেরার পথ, না আমি ইশতিয়াককে গ্রহণ করতে পারব মন থেকে। আমার মনের অবস্থা তুই বুঝবি না, নারীর এ হৃদয় পুরুষ কোনদিন বুঝতে পারে না। শুধু ছলনাময়ী আখ্যা দিয়ে যায়, বার বার। কিন্তু আমরা নারী এতটাই অসহায় ইতিহাস বদলানোর দুঃসাহস করি না কখনোই
শুধু মুখ বুজে সহ্য করে যাই। নিজের কৃতকর্মের ফল তো তবু ভোগ করতেই হবে আমার।
.
-এভাবে বলে শেষ বেলায় আর মায়া বাড়াসনে রে। অনুভূতিশুন্য হয়ে বেঁচে আছি, সেই আমার কাছে ঢের ভাল। এক ভবঘুরের আবার দুঃখ কি?
.
- তুই তো সারাজীবন আমাকে কবিতা শুনিয়েছিস, আজ শেষ বেলায় তোকে শেষের কবিতা থেকে আমার কিছু শুনাতে ইচ্ছে করছে রে,
.
ফিরিবার পথ নাহি;
দুর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে অামায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
বিভ্রান্ত বাউন্ডুলে
0 comments:
Post a Comment